মনিহার

ভালোবাসা / ফাল্গুন (ফেব্রুয়ারী ২০১৫)

Shimul Shikder
  • ৬২
বাবার বদলির চাকরী। আমরা এ জেলা সে জেলা করে বেড়াই। কোথাও বেশী দিন থাকা হয় না। আমি যখন স্কুলের শেষের দিকে তখন বাবা বদলি হয়ে পটুয়াখালীতে এলেন। আমরা কিছুদিনের জন্য সেখানেস্থির হলাম।তখন স্কুলে আমার সবচেয়ে কাছের বন্ধু ছিল মনু। ভাল নাম মানোয়ার হোসেন। গোবেচারা ধরনের ফর্শা ছেলেটি। স্বভাবে খুবই স্বল্পভাষী।মনুর সাথে বন্ধুত্বের একটা ঘটনা আছে। মনু তখন শ্রেণীর সেরা ছাত্র। ক্লাসে ফার্স্টছাড়া কখনো সেকেন্ড হয় নাই। আমি যেবার ওই স্কুলে ভর্তি হলাম, তার পরের বছরইকিভাবে যেন সেকেন্ড হয়ে গেলো। স্কুলে হৈ চৈ পড়ে যায়। স্কুলের প্রধানশিক্ষক আমাকে তাঁর কক্ষে ডেকে পাঠালেন। অনেকটা মোরগ-লড়াই দেখার মনোভাব নিয়ে আমার পিঠ চাপড়ালেন মনুকে হারিয়ে প্রথম স্থান অধিকার করার জন্য। শিক্ষকরা দুই ভাগে বিভক্ত হয়ে গেলেন। আমি যেসব শিক্ষকদের কাছে প্রাইভেট পড়তাম তাঁরা বলতেলাগলেন, তোমারএইপ্রথমস্থানধরেরাখতেহবে।পারবেতো? আমি সম্মতিসূচক ঘাড় নাড়ালাম। মনুর পক্ষের শিক্ষকরা বলতে লাগলেন, ওই ছেলেটাকে তোর হারানো চাই। শুনেছি ছেলেটা ভাল, কিন্তু গ্রামারে নাকি কাঁচা।হাতেরলেখাওনাকিভালনা। তুই একটু চেষ্টা করলে কিছুতেই তোর সাথে পারবে না।
স্কুলে যখন ভর্তি হই, তখন আমারজানা ছিলনা মনু আসলে কী জিনিষ। আস্তে আস্তে বুজতে পারি, মনুচেষ্টা করলে আসলেইওর সাথে আমি পারতাম না। কিন্তু সে চেষ্টা মনু করেনি, আর কোনদিনই করেনি। ওর মতো অসাধারণ মেধাবী আর একটা ছেলে আমার সামনে কখনো পরেনি। দরিদ্র পরিবারের সন্তান মনু। আমার তুলনায় ওর সুযোগ সুবিধাও কম। ক্লাস এইটের বৃত্তি পরীক্ষার কয়েকদিনআগের কথা।প্রচণ্ড এক ঝড়ে ওদের ঘর পড়ে যায়। খবর শুনে দেখতে গিয়ে যা দেখলাম, তাতে চমকে উঠলাম। ওর বইখাতার পৃষ্ঠাগুলো নর্দমায় ভাসছে।মনু তুলে তুলে শুকাতে দিচ্ছে। মনে মনে ভাবলাম ওর বৃত্তি পরীক্ষা এখানেই শেষ। এ ক্ষেত্রে আমার অবস্থা অন্তত তাই হতো। বৃত্তি পরীক্ষার রেজাল্ট যেদিন বের হলো সেদিন শুধু অবাকই হইনি, ওর প্রতি আমার প্রচণ্ড আগ্রহও তৈরি হল। মনু শুধু ট্যালেন্টপুলেবৃত্তিইপায়নি, পুরো বিভাগের মধ্যে প্রথম হয়েছিলো।
ক্লাস নাইনে মনুকে হারিয়ে আমি প্রথম হলাম। সারা স্কুলে আমার জয়জয়কার। কিন্তু আমার সাফল্যের রহস্যটা সবার অজানা রইলো। সে সময় মনু পড়াশুনার প্রতি আগ্রহ হারিয়ে ফেলতে শুরু করেছে। তখনতাঁর জীবনে যোগ হয়েছে নুতন দুটি বিষয়, নারী ও কবিতা। যে মেয়ের প্রেমে পড়েছিলো, তাকে নিয়ে কবিতা লিখতে শুরু করলো। কীঅসাধারণইনা ছিলসেসব কবিতাগুলো! আমার এখনো কিছু কিছু লাইন মনে পড়ে-
“ভালবাসার বাজারে গিয়েছিলাম, ভালবাসা খরিদ করবো বলে।
কতো ধরনের যে ভালোবাসা আছে, আগে জানা ছিল না।
দামি ভালোবাসা, নামী ভালোবাসা,
ছলনার ভালোবাসা, প্রতারনার ভালোবাসা,
সস্তা ভালোবাসা, নষ্ট ভালোবাসা,
অনেক ঘুরে ঘুরে খালি হাতেই ফিরে এলাম।
ভালবাসা কেনার কোন সামর্থ্যই যে আমার নেই।
ফেরার পথে দেখি পথের ধারে পড়ে আছে
মোড়কে মোড়ান কার যেন ফেলে যাওয়া ভালোবাসা।
কুড়িয়ে পাওয়া সে ভালোবাসা
বুকের ভেতর যত্ন করে রেখে দিলাম।
ভালবাসার সে মোড়ক খুলি না অজানা এক ভয়ে।
খুলে যদি দেখি কারো অপবিত্র সে ভালোবাসা।
সে ভালবাসায় এখন আমার দিন কাটে, রাত কাটে।
ভালোবাসা ছাড়া বাঁচি কী করে!”
সেসব কবিতা পড়ে ওই মেয়ের কী অনুভূতি হতো আমি জানি না, কিন্তু আমি মনুর ভক্ত হয়ে গেলাম। ওর মতো অসাধারণ মেধাবী, প্রতিভাবান, নিরহঙ্কারী বন্ধু পাওয়া সত্যিই ভাগ্যের ব্যাপার।
মনুর সাথে আমার বন্ধুত্বটা স্কুলের সীমানার মধ্যে আবদ্ধ রইলো না। আস্তে আস্তে শহরের সীমানা ছাড়িয়ে গেলো। সুযোগ পেলেই দুজনে দুটো সাইকেল নিয়ে শহর ছেড়ে কোথায় যে হারিয়ে যেতাম!মনুর কোনও সাইকেল ছিল না।বাবার অফিস থেকে ওর জন্য একটা সাইকেল আনিয়ে রাখতাম। ওর বেশীরভাগ সময়ই কাটত আমাদের বাসায়। ওদের বাসায় কখনো যাওয়া হতো না। একবার আমাকে দাওয়াত করে নিয়ে গেলো। মনুর মা নানা রকমের পিঠা-পায়েস দিয়ে আমাকে আপ্যয়ন করলো। মিষ্টিভাষী মহিলার আতিথেয়তা আমার হৃদয় স্পর্শ করলো। সেদিন এর বাহিরে আর একজন আমার হৃদয় স্পর্শ করলো। মনুর বোন। অসাধারণ তার রূপ। হালকা পাতলা গড়ন, টানা টানা চোখ, খাড়া নাক, গোলাপি বর্ণ, এক মাথা কোঁকড়ানো চুল। মনে হল শিল্পীর তুলির আঁচড়ে আঁকা কোন প্রতিমা। আমার অন্তরের সমস্ত তন্ত্রীগুলো যেন মুগ্ধ হয়ে একসাথেউচ্চারণ করলো, অসাধারণ! অসাধারণ!! আর একবার মুগ্ধ হয়ে গেলে কোন প্রকার চালাকি চলে না।সকল যুক্তিই অগ্রাহ্য হয়ে যায়। আবেগের ঘোড়া তখন চার পা তুলে লাফাতে থাকে। আমি মনুর বোন অনুর প্রেমে পড়ে গেলাম।
এরপর নানান ছুতোয় মনুদের বাসায় আমার যাওয়া-আসা বেড়ে গেলো। বিভিন্ন ছলাকলা করে তাকে আমার ভাল লাগা বুঝানোর চেষ্টা করতে লাগলাম।সে অসম্ভব বুদ্ধিমতী হাওয়া সত্ত্বেও আদৌ কিছু বুজতো বলে মনে হচ্ছিলো না। বরং আমি মুগ্ধ হয়ে যাচ্ছিলাম তার ব্যক্তিত্ব, গাম্ভীর্য, বুদ্ধিমত্তা দেখে। ধীরে ধীরে মনে হল আমি তলিয়ে যাচ্ছিঅনুর প্রেমের অতল গভীরে। আর অপেক্ষা করতে পারছিলাম না। একদিন আড়ালে পেয়ে ইনিয়ে বিনিয়ে মনের কথাটাবোঝানোর চেষ্টা করলাম। কী বুজল, কিছুই বুজলাম না। আমার দিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকে চলে গেলো।এরপর থেকে আচার ব্যবহারে, ভাবে ভঙ্গিতে আমাকে বুঝিয়ে দিলো আমাকে সে গ্রাহ্যের মধ্যেই আনছে না। আমার ব্যপারে একেবারে নির্বিকার। আমার আত্মসন্মানেএকটু আঘাত লাগলো।
এরপর দেখা হলে কদাচিৎ কথা হতো অনুর সাথে। কিন্তু ওর কথার উদ্দেশ্য থাকতো একটাই, আমাকে হেয় করা। একদিন বলল- ভাইয়ার ক্লাসে আপনিই বুঝি ফার্স্ট বয়?
যা সত্য তাই বললাম, হ্যাঁ।
- ভাইয়া তো লেখাপড়া ছেড়ে প্রেম করে বেড়াচ্ছে। তাই ফার্স্ট হওয়ার সুযোগ পাচ্ছেন।
কথা সত্য। কিন্তু এভাবে বলার দরকার ছিল না।
- তুমি চাও না আমি ফার্স্ট হই?
- বিষয়টা আমার চাওয়া না চাওয়ার নয়, বিষয়টা যোগ্যতা নিয়ে। যোগ্য স্থানে যোগ্যকেই মানায়।
- আমি কী এতই অযোগ্য?
- আপনি অযোগ্য একথা কে বলল? প্রশ্নটা হচ্ছে ফার্স্ট হাওয়ার জন্য আসলে কতটা যোগ্য?
অনুযুক্তিদিয়েকথাবলে।ওরসাথেকথায়পেরেওঠাকঠিন।আমিচুপচাপশুনেযেতাম।এভাবেচলতেথাকল।
স্কুল শেষ করে কলেজে পা রাখলাম। মোটা মোটা বই। দু’বছরে শেষ করতে হবে। মনে হল নদী থেকে সাগরে এসে পড়েছি। ব্যস্ততা বেড়ে গেলো। ম্যাট্রিক পরীক্ষার সময়েমনুর প্রেমে টানা পোড়ন চলছিল। তাই ফলাফল আশানুরূপ হয়নি। কলেজে উঠে ও নানা রকম সভা সমিতি নিয়ে ব্যস্ত হয়ে পড়লে। কিন্ত আমার সাথে ওর যোগাযোগে ছেদ হল না। অনুই হয়তো এর মূল কারণ ছিল। আমি যে ওর উত্তরেরঅপেক্ষায় আছি। মনের মাঝে ভালবাসার যে বীজ বপন করেছিলাম, সময়ের সাথে সাথে তা কখন যে বৃক্ষে পরিণত হয়েছে, নিজেও টের পাইনি। বয়সের সাথে সাথে অনুর যৌবনের মাদকতা ও বাড়তে লাগলো। এখন আর চোখ ফেরানো যায় না। আমারও সদা জাগ্রত যৌবন। দেখতে দেখতে ভালবাসার সে বৃক্ষ ফুলে ফলে ভরে গেলো। আমার বিশ্বাস ছিল,বয়েসের সাথে সাথেঅনু নিশ্চয়ই একদিনআমার এ ভালবাসার মূল্য বুঝবে আর আমারও অপেক্ষার দিন শেষ হবে। কিন্তু অবস্থা পরিবর্তনের কোন লক্ষণ দেখা গেলো না। প্রথম প্রেমে পড়লাম। শয়নে স্বপনে যাকে ধারন করি, সে তো ভাল করে কথাই বলে না। বরং আচার আচরণে, ভাব ভঙ্গিতে আমার প্রতি তার অবজ্ঞার পরিমাণ যেন দিনে দিনে বাড়তে লাগলো। এ কেমন প্রেম?
দেখতে দেখতে কলেজ শেষ হয়ে গেলো। ঢাকাবিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হয়েছি। এদিকেবাবাও ঢাকাতে বদলি হয়েছে। আমাদের পটুয়াখালীর পাট চুকাবার পালা। অনুর সাথে সরাসরি কথা বলার সাহস সঞ্চয় করলাম। আড়ালে পেয়ে মনের কথাগুলোবলার জন্য আমতা আমতা করছিলাম। ও হেসে বলল, কথাও তো গুছিয়ে বলতে পারেন না। আমি আরো অপ্রস্তুত হয়ে গেলাম। আর কিছু বলা হল না। ‘না’ শব্দটা বলা তো খুব সহজ। অনু কিন্তু আমাকে ‘না’ বলছে না। আমার বিশ্বাস, ও আমার ভালবাসার পরীক্ষা নিচ্ছে, আমি ও পরিক্ষা দিয়ে যাচ্ছি।পটুয়াখালী ছাড়ার আগের দিন ওকে দেখার জন্য, ওর সাথে একটু কথা বলার জন্য মন অস্থির করতে লাগলো। শেষবিকেলে এক কাণ্ড করে বসলাম।মা’র গহনার বাক্স থেকে মা’র বিয়ের মনিহার পকেটে পুরে সোজা হাজির হলাম ওদের বাসায়। কোত্থেকে এতো সাহস পেলাম নিজেও জানি না। ভাগ্যিস মনু বাসায় ছিল না। চলে যাচ্ছি শুনে মনুর মা মন খারাপ করলো। তিনি ভিতরে গেলেন আপ্যয়নের ব্যবস্থাকরতে। একা পেয়ে মনিহারটা ওর হাতে তুলে দিয়ে বললাম, এই হারটা আমার দাদীর শাশুড়ি দাদীকে দিয়েছিলেন, দাদী দিয়েছিলেন আমার মাকে, আমার মা রেখে দিয়েছেন তার একমাত্র পুত্রবধুর জন্য। আজ থেকে এ মনিহার তোমার।অনু আমাকে হেয় করার শেষ সুযোগটা যেন ছাড়ল না। মণিহারটা টেবিলে উপর ছুঁড়ে ফেলে বলল, হুহ! আয়নায় নিজের চেহারা দেখেছেন কখনো?আমি হতভম্ব হয়ে গেলাম। অনু আমাকে এভাবে আক্রমণ করবে এটা অন্তত কল্পনা করিনি। আমি কালো, দেখতে সুন্দর না। কিন্তু এ নিয়ে আমার নিজের খুব একটা খেদ কোন কালেই ছিল না। আজ প্রথমবারের মতো নিজের চেহারা নিয়ে আমি অসহায় বোধ করতে লাগলাম।কোনও উত্তর খুঁজে পেলাম না। আর কি-ই বা বলবো? চুপ করে বেরিয়ে এলাম।
সেদিন ঘোরের মধ্যে নদীর পাড় দিয়ে একা একাকতদূর, কতক্ষণ হেঁটেছিলাম তা আর মনে পড়ছে না। আমার প্রথম প্রেমের জন্ম হল, ধীরে ধীরে তা পরিণত হল, তারপর হটাৎ একদিন আমাকে ছেড়ে কোথায় যেন চলে গেলো।আমার মনের ভিতরে দুইটা সত্ত্বা তৈরি হল। একটা সত্ত্বা আমার পক্ষে, অপরটা অনুর পক্ষে তর্ক শুরু করলো। অনুর পক্ষেরটা বলল, ওর মতো রূপ আর কার আছে? তার তো অহংকার থাকবেই। ওই অহংকারই ওর অলঙ্কার। এই অহংকার কেবল ওরই মানায়।কতটা সাধনা করেছিস যে ওর মতো রূপসীর মনের নাগাল পাবি? আমার পক্ষের সত্ত্বা বলছে, স্বীকার করি সে সুন্দর। আর শুধু সৌন্দর্যই কী সব কিছু? তাছাড়া তুই-ই বা কম কিসে?গায়ের রং কালো, এই কী সব? তোর মতো ভালো ওকে আর কে বাসবে?
রাতে বাসায় ফিরে দেখি হুলুস্থুল অবস্থা।পুলিশের সামনেবাসার সব কাজের লোকদের জড় করা হয়েছে। মনিহার চুরির দায়ে তাদের জেরা চলছে। মা তাঁর সন্দেহের তীর একে একে সবার দিকেই ছুড়ল, শুধু আমি ছাড়া। এক পর্যায়ে মা বাবাকেও সন্দেহ করা শুরু করলো। বাবার জুয়া খেলার অভ্যাস ছিল।
পরের দিনখুব সকালে আমরা পটুয়াখালী ছাড়লাম। বুকের ভিতর থেকে কী যেন ছিঁড়ে গেলো। কী যেন পেছনে রেখে গেলাম।
বিশ্ববিদ্যালয়ের সময়গুলো অনেকটা নিরসভাবেকাটতে লাগলো। মনু ভর্তি হল আর্ট কলেজে। মুখ ভর্তি দাড়ি গোঁফ নিয়ে মাঝে মাঝে আমার হোস্টেলে হাজির হয়। চুপ চাপ কিছুক্ষণ বসে থাকে, এক কাপ চা খায়, আবার চলে যায়। অনুর বিষয়ে আমি কখনো কিছু জিজ্ঞেস করি না। ওকে ভুলতে পারি না, আবার মনে রাখতেও কষ্ট হয়। ওকে পাওয়ার আশা আর করি না।
এরমধ্যে মনুর বাবা মারা গিয়েছে, মনু মাদকাসক্ত হয়েছে,আমার জানা মতে অনুর এখনো বিয়ে হয় নাই। মনু ছাড়া সংসারে উপার্জনক্ষম আর কেউ নেই। সংসার কিভাবে চলছে কে জানে। কখনো জিজ্ঞেস করা হয় না।
বিশ্ববিদ্যালয়ের জীবন শেষ হাওয়ার আগেই জাপানে মনবুশ স্কলারশিপ পেয়ে গেলাম। মা তাড়াহুড়ো করে আমার বিয়ের জন্য পাত্রী দেখতে লাগলেন। বিয়ে না দিয়ে তিনি কিছুতেই বিদেশে যেতে দিবেন না। কিছুদিনের মধ্যে একটা পাত্রী জোগারও করে ফেললেন। দেখতে সুন্দর, শিক্ষিত, ভালো বংশ, ভালো পরিবারের মেয়ে। সরকারের কোন এক মন্ত্রীর আপন ভাতিজি। ঢাকার এক রেস্টুরেন্টে আনুষ্ঠানিক ভাবে পাত্রীর সাথে আমার পরিচয় হল। পাত্রীর নাম ফারজানা চৌধুরী বর্না। স্বভাবে মার্জিত, ভদ্র, মৃদুভাষিণী, মৃদুহাসিনী। খুব মনোযোগ দিয়ে সব কথা শোনে। ভেবে চিন্তে যুক্তি দিয়ে উত্তর দেয়। সে উত্তরে ভুল হাওয়ার সুযোগ কম।ফারজানা চৌধুরী বর্নাকেআমার ভালো লেগে গেলো। আমরা এখন রাত জেগে ফোনে কথা বলি, এক সাথে বাহিরে ঘুরি, নামীদামী রেস্টুরেন্টে ডিনার করি। ঘুমানোর সময় চোখ বুঝে বুঝে ফারজানা চৌধুরী বর্নার কথা ভাবি। ভাবতে ভালো লাগে।
হটাৎ একদিন লক্ষ্য করলাম, আমার মনের ভিতর অনুর আর কোন স্থান নেই। সে স্থান পুরোপুরি দখল করে নিয়েছে ফারজানা চৌধুরী বর্না। পৃথিবীতে মানুষের মনের চেয়ে বিচিত্র আর কিছু নাই। যে অনুর জন্য একসময় বাঁচতে-মরতে ইচ্ছে হতো তা এখন পুরোপুরি অতীত।
এদিকে আমাদের বিয়ের দিন তারিখ ঠিক হল। উত্তরাধিকার সুত্রে পাওয়ামা’র সেই হারিয়ে যাওয়া মনিহারের শোক কিন্তু মা এখনো ভুলতে পারেননি। ভুলবেই বা কী করে? এ মনিহার যে তিনি আগলে রেখেছিলেন তাঁরপুত্রবধুর জন্য। নিজের বিয়ের পুরনো ছবি দেখেসেই মনিহারের মতো হুবহু আর এক সেট বানাতে দিলেন। খানদান বলে কথা।
বিয়ে বাড়িতে আত্মীয়স্বজন গিজগিজ করছে। এরকম হট্টগোলের ভিতর হঠাৎ মনু এসে হাজির। ওর মুখে যা শুনলামতাতে আমার মাথায় বাজ পড়লো।
ক্যান্সারে আক্রান্ত হয়ে অনু হাসপাতালে শয্যাশায়ী। আমাকে দেখতে চাচ্ছে।বলতে বলতে মনুহুহু করে কেঁদে উঠলো। ছুটে গেলাম হাসপাতালে। বিছানায় শোয়া অনুকে দেখে চমকে উঠলাম। মনে হচ্ছে একটা কঙ্কাল বিছানার সাথে লেগে আছে।তার সেই অনিন্দ্য সুন্দর মুখটা কালো বিবর্ণ হয়ে গিয়েছে। মাথার প্রায় সব চুল পড়ে গেছে।আমাকে দেখে অনুর পাশে বসা ওর মা হাউমাউ করে কাঁদতে লাগলো। কিন্তু অনুর কোনও ভাবান্তর হল না। ওকে খুব স্বাভাবিক মনে হল। ও উঠে বসার চেষ্টা করলো। মনু আর ওর মা ধরাধরি করে আধশোয়া ভাবে বসিয়ে দুজনেই বাহিরে চলে গেলো,সম্ভবত আমাদের দুজনকে একান্তে কথা বলার সুযোগ করে দিতে। এতক্ষণ অনু অন্য দিকে তাকিয়ে ছিল। এবার আস্তে আস্তে বালিশের নিচ থেকে যা বের করে আমার হাতে দিলো তা দেখে আমি চমকে উঠলাম। অনুর কাছে রেখে আসা আমার মায়ের সেই মনিহার। আমি নির্বাক হয়ে রইলাম কিছুক্ষণ। বললাম,এইমনিহারেরমূল্যমনেহয়তুমিবুজতেপারনি।তাছাড়াএটাতোতোমারকাছেজমারাখিনি, এটাছিলস্বীকৃতি।
অনু এই প্রথম মুখ খুলল। খুব নিচু গলায় বলল,
-ভালবাসা কী স্বীকৃতিদেওয়ারজিনিস?তোমারকাছেকেচেয়েছেএইস্বীকৃতি?
ওকাঁপতেলাগলো।মনেহচ্ছেওরশ্বাসকষ্টহচ্ছে।হঠাৎউত্তেজিতহয়েবলতেলাগলো,
- তুমি আমাকে ভালোবাসনি, কখনো বাসনি, তুমি যেটা করেছ তাকে বলে করুনা। তুমি চেয়েছিলে আমাকে দয়া করতে। আমি তোমার কাছে চেয়েছিলাম শুধুই ভালোবাসা। করুনা নয়, দয়া নয়। তা তুমি আমায় দিতে পারনি।
অনুকাশতেকাশতেরক্তবমিকরেদিলো।মনু, ওরমাদৌড়েএলো।সবাইধরাধরিকরেশুইয়েদিলাম।নার্সরাওকেনিয়েব্যস্তহয়েপড়লো।
আসলেই কি আমি অনুকে দয়া করেছি? দরিদ্র পরিবারের অসাধারণ সুন্দরী এক মেয়েকে করুনাবসত মুক্তি দিতে চেয়েছি? তাতে কি কোন ভালোবাসা ছিল না? না কি প্রখর আত্মমর্যাদা সম্পন্ন অনুর মনের ভিতর দারিদ্রতার কারণে তৈরি হাওয়াএক ধরনের হীনমন্যতা। কেন অনুর কাছে মনে হয়েছিলো আমি যা করছি তা করুনা বা দয়া, ভালোবাসা না? অনু এই প্রথম আমাকে ‘তুমি’ করে বলছে।আজমনে হল, অনুর প্রেমের গভীরতায় আমি আসলে পৌঁছতেই পারিনি।অনুর ভালবাসার কাছে আমি পরাজিত।
কতক্ষণ পার হল জানিনা। অনু চোখ খুলল।মনু এবং মনুর মা’র সামনেইমণিহারটি আমি অনুর গলায় পড়িয়ে দিয়ে দিলাম।এই মনিহার আমার দাদা, আমার বাবার ভালবাসার সাক্ষী। আজ এটা আমার নিষ্পাপ, নিষ্কলুষ, নিঃস্বার্থ প্রেমের সাক্ষী হয়ে থাকল। অনু আমার জীবনের প্রথম প্রেম এবং আমারজীবনের শেষ প্রেম।
অনু আমাকে জড়িয়ে ধরে হু হু করে কাঁদতে লাগলো।
সেদিন শেষ বিকেলের পরন্ত বেলায় অনুমারা যায়।
আপনার ভালো লাগা ও মন্দ লাগা জানিয়ে লেখককে অনুপ্রানিত করুন
মিলন বনিক নিটোল কথার সুন্দর গাথুনি....অপূর্ব....খুব ভালো লাগলো....শুভ কামনা....
ভালো লাগেনি ৯ ফেব্রুয়ারী, ২০১৫
রবিউল ই রুবেন গল্পটি পড়ে খুবই ভালো লাগল। ভালোলাগা স্বরূপ ভোট রইল। সময় পেলে আমার কবিতাটা পড়বেন।
ভালো লাগেনি ৭ ফেব্রুয়ারী, ২০১৫
Thanks for your support.
ভালো লাগেনি ৭ ফেব্রুয়ারী, ২০১৫
মোহাম্মদ সানাউল্লাহ্ প্রকৃতির কাছে আগেই যে হেরে বসে আছে সে নতুন করে আর কি হারবে ! তবে প্রেমকে হয়তো অমর করে রাখার একটা আকাঙ্খা তার ভেতরে কাজ করে থাকতে পারে ! খুব ভাল লাগল ।
ভালো লাগেনি ৫ ফেব্রুয়ারী, ২০১৫
thanks for your comments
ভালো লাগেনি ৫ ফেব্রুয়ারী, ২০১৫
জুন ভালো এঁকেছেন। পড়ে মন ভরে গেলো। খুব ভালো সাজিয়েছেন পুরোটা। অনুর পরিনতিতে খুব খারাপ লেগেছে। ভালো লাগা সাথে ভোট দিয়ে গেলাম। সম্ভব হলে আমার পাতায় আসবেন।
ভালো লাগেনি ৪ ফেব্রুয়ারী, ২০১৫
Thanks for your comments. I will go through your writings.
ভালো লাগেনি ৪ ফেব্রুয়ারী, ২০১৫
মোঃ আক্তারুজ্জামান খুব বর্ণীল গল্প। অনুরা আসলে মরে না। ওরা অদৃশ্য হয়। চোখ বন্ধ করে দেখুন কেমন উজ্জ্বল থেকে উজ্জ্বলতর চোখে আপনার দিকে অপলক তাকিয়ে আছে! অনেক ভালো লাগা নিয়ে ফিরলাম। ধন্যবাদ।
ভালো লাগেনি ৪ ফেব্রুয়ারী, ২০১৫
Thanks for your deliberate comment.
ভালো লাগেনি ৪ ফেব্রুয়ারী, ২০১৫

১৬ অক্টোবর - ২০১৪ গল্প/কবিতা: ৬ টি

বিজ্ঞপ্তি

এই লেখাটি গল্পকবিতা কর্তৃপক্ষের আংশিক অথবা কোন সম্পাদনা ছাড়াই প্রকাশিত এবং গল্পকবিতা কর্তৃপক্ষ এই লেখার বিষয়বস্তু, মন্তব্য অথবা পরিণতির ব্যাপারে দায়ী থাকবে না। লেখকই সব দায়ভার বহন করতে বাধ্য থাকবে।

প্রতি মাসেই পুরস্কার

বিচারক ও পাঠকদের ভোটে সেরা ৩টি গল্প ও ৩টি কবিতা পুরস্কার পাবে।

লেখা প্রতিযোগিতায় আপনিও লিখুন

  • প্রথম পুরস্কার ১৫০০ টাকার প্রাইজ বন্ড এবং সনদপত্র।
  • দ্বিতীয় পুরস্কার ১০০০ টাকার প্রাইজ বন্ড এবং সনদপত্র।
  • তৃতীয় পুরস্কার সনদপত্র।

আগামী সংখ্যার বিষয়

গল্পের বিষয় "ছোটবেলা”
কবিতার বিষয় "ছোটবেলা”
লেখা জমা দেওয়ার শেষ তারিখ ২৫ ডিসেম্বর,২০২৪